বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এই অফিসের তহশিলদার আমির হোসেন মল্লিকের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম, অনিয়ন্ত্রিত ঘুষ বানিজ্য এবং সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তার অফিসে একটি বিশেষ চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যেখানে কম্পিউটার অপারেটর ইমরান হোসেন, মোঃ সুমন, আঃ রহমান, আঃ রব, রফিক ফকিরসহ আরও কয়েকজন সক্রিয়ভাবে ভূমি সংক্রান্ত সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সরাসরি অনুসন্ধান ও ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতায় জানা গেছে, তহশিলদারের অফিসে কোনো ফাইল ঘুষ ছাড়া অগ্রসর হয় না। সেবাপ্রত্যাশীরা মিউটেশন, নামজারি, খারিজ, খতিয়ান, দলিল কিংবা যেকোনো প্রকার ভূমি সংক্রান্ত কাজে গেলে আগে তাদের কাছে ‘সেবা ফি’ চাওয়া হয়। যদিও সরকারি বিধি অনুযায়ী এসব কাজে নির্ধারিত সরকারি ফি ছাড়া অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ভিডিও প্রমাণে ধরা পড়ল ঘুষ বাণিজ্য :
সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তহশিলদার আমির হোসেন মল্লিক নিজ হাতে এক সেবা প্রত্যাশীর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। ওই টাকা নেয়ার পর তিনি ফাইলের উপর একটি চিহ্ন দিয়ে রাখেন, যা মূলত ফাইল অগ্রসর করার অনুমোদন হিসেবে ব্যবহার হয়। ভিডিওটি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
সিন্ডিকেটের দাপট:
অভিযোগ রয়েছে, তহশিলদারের অধীনে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সেবাপ্রত্যাশীদের জিম্মি করে রেখেছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের দেওয়া হয় হুমকি, এমনকি মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখানো হয়। স্থানীয়রা বলছেন, এটি শুধু সাধারণ দুর্নীতি নয়, বরং একটি ‘অনিমা দুর্নীতি’—যেখানে পদ্ধতিগতভাবে অফিসের সব সেবা একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ২০ জনের বক্তব্য:
সংবাদকর্মীরা মাঠে গিয়ে ভুক্তভোগী অন্তত ২০ জন সেবা প্রত্যাশীর বক্তব্য নেন। তারা প্রত্যেকেই ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন।সো
সোহাগ মৃধা বলেন– “আমি মিউটেশনের জন্য গেলে ৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়। না দিলে ফাইল আটকে রাখবে বলে জানানো হয়। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েছি।”
মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন – “নামজারির জন্য তিন মাস ধরে দৌড়াচ্ছি। সরকারি ফি জমা দিলেও অতিরিক্ত টাকা ছাড়া ফাইল হাতে পাচ্ছি না।”
হাবিবুর রহমান বলেন– “ভূমি অফিসে গেলে মনে হয় বাজারে গেছি। প্রতিটি ধাপে টাকা দিতে হয়।”
মোঃ সেলিম বলেন – “কম্পিউটার অপারেটর ইমরান সরাসরি বলে দেন, ‘তহশিলদারের নির্দেশ ছাড়া ফাইল নড়বে না।’”
জাহিদ হোসেন বলেন – “মিউটেশনের জন্য ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। আমি অস্বীকার করলে গালিগালাজ করা হয়।”
শেখ কামাল বলেন– “আমার নামে জমির খারিজ করতে গিয়ে তিন দফায় টাকা দিতে হয়েছে।”
রুবেল হাওলাদার বলেন – “ভূমি অফিস মানেই ভোগান্তি। সরকারি দপ্তর হয়েও এটি যেন ব্যক্তিগত ব্যবসা কেন্দ্র।”
মোঃ শামীম বলেন – “আমি প্রতিবাদ করায় আমার ফাইল ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হয়েছে।”
আব্দুল মালেক বলেন – “যতক্ষণ টাকা না দেন, ফাইল হাতে পাবেন না—এই নিয়ম চালু করেছেন তারা।”
সাবেক ইউপি সদস্য লতিফ বলেন – “আমি নিজেও ভুক্তভোগী। সাধারণ মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারে না।”
রুবিনা আক্তার বলেন – “মহিলাদের সাথেও দুর্ব্যবহার করা হয়। তবুও টাকা ছাড়া কাগজপত্র মেলে না।”
মোঃ সাইদুল বলেন – “ভূমি অফিস এখন আর সরকারি সেবা কেন্দ্র নয়, ঘুষের হাটবাজার।”
আজিজুল হক বলেন – “আমার খতিয়ান তুলতে ১৫০০ টাকা দিতে হয়েছে, অথচ সরকারি ফি ছিল মাত্র ১০০ টাকা।”
আব্দুস সালাম বলেন – “অফিসে গেলে তারা সিন্ডিকেট করে ফাঁদ পাতে। টাকা না দিলে কাজ হয় না।”
মোঃ করিম বলেন– “আমার জমির নকল তুলতে দেড় বছর লেগেছে। প্রতি ধাপে ঘুষ দিতে হয়েছে।”
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন – “একজন নারী হয়ে অফিসে গিয়েছিলাম, কিন্তু ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়েছে।”
আনিসুর রহমান বলেন– “আমি প্রতিবাদ করেছি বলে তারা মিথ্যা কেস দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।”
সাবেক শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন– “সরকারি চাকুরিজীবী হয়েও তারা ব্যবসায়ী মানসিকতায় কাজ করছেন।”
মোঃ বাবুল বলেন – “ঘুষ না দিলে তারা নানাভাবে হয়রানি করে। এটি দীর্ঘদিনের সমস্যা।”
আবদুর রাজ্জাক বলেন– “আমি মনে করি, এটি সংগঠিত দুর্নীতি। প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।”
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া :
বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজহারুল ইসলাম জানান, “চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আমির হোসেন মল্লিকের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে অবশ্যই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভূমি অফিসে কোনো ধরণের ঘুষ বা অনিয়ম বরদাশত করা হবে না।”
জনমনে ক্ষোভ ও প্রত্যাশা :
এলাকাবাসী বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই দুর্নীতি চলে আসলেও এখন এর অবসান হওয়া জরুরি। তারা দাবি তুলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং জেলা প্রশাসনের উচিত সরেজমিন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুর্নীতি আরও বাড়বে এবং সাধারণ মানুষ আরও বেশি হয়রানির শিকার হবে। অতএব চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের এই কেলেঙ্কারি শুধু একটি অফিসের দুর্নীতি নয়, বরং গোটা ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থার একটি ‘অনিমা দুর্নীতি’র চিত্র।’ সাধারণ মানুষ সরকারি সেবা পেতে গিয়ে যখন ঘুষ দিতে বাধ্য হন, তখন তাদের আস্থা নষ্ট হয় সরকারের প্রতি। তাই এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়বে।