বরিশাল শিল্পকলা একাডেমী—যেখানে সংস্কৃতি চর্চার বাতিঘর হওয়ার কথা, সেখানে চলছে সরকারি অর্থ লুটপাটের মহোৎসব। অভিযোগ উঠেছে, দুই হাজার টাকার কাজ দেখিয়ে তোলা হয়েছে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত বিল। এমনকি একটি সাধারণ ফেসবুক লাইভ দেখানো হয়েছে পাঁচ হাজার টাকার ব্যয়ে! এই ধরনের ভুয়া বিল-ভাউচার ও কাগজপত্রের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষ।
সরকারি নথি ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, সম্প্রতি প্রায় ২৯ লাখ টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের নামে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিতর্কিত এক জাসাস নেতার নামও ঘুরপাক খাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই লুটপাটের দায় নেবে কে? সরকারি অর্থ আত্মসাতের এ অরাজকতা রুখবে কে?
প্রেক্ষাপট :
বরিশাল শিল্পকলা একাডেমী দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। নাটক, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজন হয় এই প্রতিষ্ঠানে। সরকার প্রতিবছর এই একাডেমীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। কিন্তু সেই অর্থ কতটা কাজে ব্যবহার হচ্ছে, আর কতটা কাগজে-কলমে শেষ হয়ে যাচ্ছে—সেই প্রশ্ন উঠেছে আবারও।
কিভাবে হচ্ছে লুটপাট?
স্থানীয় এক সূত্র জানায়—দুই হাজার টাকার কাজ দেখানো হয়েছে বিশ হাজার টাকা।
একটি সাধারণ ফেসবুক লাইভ এর খরচ ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা।
ব্যানার ও পোস্টার প্রিন্টের খরচে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে দশগুণ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে বিল তোলা হলেও বাস্তবে সেই অনুষ্ঠানের মান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের।
একজন সাংস্কৃতিক কর্মী অভিযোগ করে বলেন— “আমরা তো অনুষ্ঠান করেছি, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছে হয়তো ২০-২৫ হাজার টাকা। অথচ সরকারি হিসাবের খাতায় খরচ দেখানো হয়েছে লাখ টাকার উপরে। আমরা নিজেরাই অবাক হয়েছি।”
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের ক্ষোভ : বরিশালের নাট্যকর্মী দেলোয়ার হোসেন বলেন— “সংস্কৃতি চর্চার নামে এভাবে যদি টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়, তাহলে প্রকৃত শিল্পীরা কোথায় যাবে? একাডেমীর বাজেটের টাকায় নতুন নাটকের মঞ্চ, আলো-সাউন্ড সিস্টেম, অথবা শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। অথচ হচ্ছে উল্টোটা। টাকার সিংহভাগ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে কিছু অসাধু মহল।”
আরেকজন সংগীতশিল্পী নিশাত পারভীন বলেন— “আমরা শিল্পীরা অনুষ্ঠানে পারিশ্রমিক পাই না, অথচ বিল ভাউচারে লাখ লাখ টাকা দেখানো হয়। আমাদের জন্য বরাদ্দ টাকা যদি নেতাদের পকেটে চলে যায়, তাহলে শিল্পীরা কিভাবে টিকে থাকবে?”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া :
এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভও প্রবল।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন—> “আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে সরকার বরাদ্দ দেয়। সেই টাকা যদি সংস্কৃতির নামে লুট হয়, তবে সেটা জাতির সাথে প্রতারণা।”
একজন কলেজ শিক্ষক রওশন আরা বলেন— “শিল্পকলা একাডেমী আমাদের গর্বের জায়গা। অথচ এখানে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। এটা থামাতে না পারলে তরুণ প্রজন্মের সংস্কৃতিচর্চা মুখ থুবড়ে পড়বে।”
বিতর্কিত জাসাস নেতার নাম :
স্থানীয় সূত্র দাবি করছে, এই লুটপাটে সরাসরি জড়িত একজন বিতর্কিত জাসাস নেতা। তিনি এক সময় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমীর বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। অভিযোগ আছে, তিনি স্থানীয় প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ ভাগবাটোয়ারার প্রধান ভূমিকা পালন করছেন।
সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য :এ বিষয়ে বরিশাল শিল্পকলা একাডেমীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—
“আমরা ওপর মহলের নির্দেশে কাজ করি। বাজেট বরাদ্দ আসে ঢাকায় থেকে। এখানে অনেক সময় খরচের হিসাব ঠিক মতো মেলে না। তবে আমাদের হাতে বেশি কিছু করার থাকে না।”
বরিশাল জেলা প্রশাসকের দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন—
“অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি বরাদ্দের টাকা সংস্কৃতি চর্চায় ব্যয় হওয়া উচিত, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়।”
তদন্তের দাবি :
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ জোর দাবি তুলেছেন যেন অবিলম্বে এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে।
বরিশাল প্রেসক্লাবের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন “এখানে প্রকাশ্যেই সরকারি অর্থ লুট হচ্ছে। কাগজে-কলমে খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে তা হয়নি। এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া জরুরি।”
বিশ্লেষণ :
সরকার প্রতি বছর সংস্কৃতি চর্চায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। বরিশাল শিল্পকলা একাডেমীর এই ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এখানে দেখা যাচ্ছে—
বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক অডিট হচ্ছে না।
প্রশাসনের ভেতরের কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সাথে যোগসাজশ করে অর্থ ভাগবাটোয়ারা করছে।
প্রকৃত শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ ভুয়া কাগজপত্রে কোটি টাকা উড়ছে।
করণীয় :
অবিলম্বে বরিশাল শিল্পকলা একাডেমীর ব্যয়ের অডিট করা।
ভুয়া বিল-ভাউচারের দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বাজেট বাস্তবায়ন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও গণমাধ্যমের নজরদারি বৃদ্ধি করা।
বরিশাল শিল্পকলা একাডেমীতে সরকারি অর্থ আত্মসাতের এই হরিলুট শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়, এটি সমগ্র দেশের সংস্কৃতিচর্চার জন্য হুমকি। শিল্প-সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণশক্তি। আর যদি সেই প্রাণশক্তির বাজেটই দুর্নীতির ভাগবাটোয়ারায় শেষ হয়ে যায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের সংস্কৃতি বিকাশ কিভাবে হবে? জনগণের টাকার জবাবদিহিতা জনগণের কাছেই দিতে হবে। তাই আজ প্রশ্ন তুলছে বরিশালের মানুষ—
👉 “এই ২৯ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারার দায় নেবে কে?”
👉 “সরকারি অর্থ লুটপাটের এ ভূড়িভোজ থামাবে কে?”