বরিশাল বিআরটিসি বাস ডিপো— একসময় সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হলেও বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের এক আতুরঘরে। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার একটি শ্রমিক লীগ নামধারী গোষ্ঠী পুরো ডিপো নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি হেড অফিস পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তৃত বলে জানা গেছে।
🔹 শাস্তিমূলক বদলি: গোপালের পতন নাকি নাটকের নতুন অধ্যায়?
সম্প্রতি আলোচিত ও বিতর্কিত ম্যানেজার গোপালের জামিল হোসেনকে শাস্তিমূলক বদলি করে টুঙ্গিপাড়া ডিপোতে পাঠানো হয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও পার্সেল) মেজর নিজামুদ্দিন স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই বদলি কার্যকর হয়।
এর আগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ফোরম্যান শাহাদাত হোসেন রতনকে ঢাকা হেড অফিসে বদলি করা হয়।
কিন্তু তাদের মতে, এই বদলি শুধু ‘শাস্তি’ নয়— এটি ছিল ডিপোর ‘অদৃশ্য সরকারের’ ইচ্ছারই প্রতিফলন।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারী বলেন,
> “ম্যানেজার জামিল আর ফোরম্যান রতন শ্রমিক লীগ নামধারী সিন্ডিকেটের নির্দেশ না মেনে কাজ করছিলেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ তদন্ত আর বদলির নাটক সাজানো হয়।”
🔹 ১৫ বছরের দখলদারিত্ব: ‘শ্রমিক লীগ’ নামের সিন্ডিকেট
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৫–১৬ বছর ধরে বরিশাল বিআরটিসি বাস ডিপোতে একদল চালক ও কন্ডাক্টর নিজেদেরকে “শ্রমিক লীগ নেতা” পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ফোরকান, আজমল, ফেরদৌসসহ প্রায় ১০–১২ জনের এই সিন্ডিকেট শুধু ডিপো নয়— হেড অফিসের প্রশাসন পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে।
তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ীই বদলি, নিয়োগ, এমনকি ডিপোর ভাড়া ও বাস চলাচল সূচিও নির্ধারিত হয়।
একজন সাবেক কর্মচারী বলেন,
> “যে কর্মকর্তা তাদের খুশি রাখতে পারে না, সে টিকতে পারে না। বদলিই তার ভাগ্য।”
🔹 দুর্নীতির ফর্মুলা: কমিশন, ঘুষ আর কালোবাজারি
তদন্তে জানা যায়, বিআরটিসি বাসের টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে পার্সেল ভাড়ার হিসাব পর্যন্ত ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যে জড়িত এই সিন্ডিকেট।
দৈনিক টার্নওভার থেকে গোপনে অংশ নেয় তাদের তথাকথিত শ্রমিক লীগ নেতারা।
একজন কর্মকর্তা বলেন,
> “সরকারি রাজস্ব খাতের বড় অংশ নিয়মিত গিলে খায় এই চক্র। প্রতিদিন লাখ টাকার হিসাব গোপন করা হয়।”
এছাড়াও, চাকরিতে নিয়োগ কিংবা বদলির জন্যও রয়েছে অবৈধ অর্থ লেনদেনের প্রথা।
🔹 নতুন ম্যানেজারের আগমন, পুরনো গোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধি
সম্প্রতি নতুন ম্যানেজার জুলফিকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
তাঁর সঙ্গে এই সিন্ডিকেটের পূর্ববর্তী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জুলফিকার একসময় এই ডিপোতেই টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) ছিলেন। তখন থেকেই শ্রমিক লীগ নামধারী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে কর্মচারীরা জানান।
নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সিন্ডিকেট নেতারা নাকি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে—
> “এখন ডিপো চালাবে আমরা, ম্যানেজার আমাদের মানুষ।”
এ ঘটনায় সাধারণ চালক-কন্ডাক্টরদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন।
🔹 প্রশাসনিক দুর্বলতা ও তদারকির অভাব
দুর্নীতির মূল কারণ হিসেবে কর্মচারীরা বলছেন— প্রশাসনিক তদারকির ঘাটতি ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া।
বিআরটিসির হেড অফিসে পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাদের প্রভাবে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।
একজন সাবেক সিনিয়র সুপারভাইজার বলেন,
> “ঢাকা অফিসে যারা আছে, তাদের আশীর্বাদেই সিন্ডিকেট টিকে আছে। নইলে এত বছর ধরে কেউ টিকে থাকতে পারে না।”
🔹 স্বচ্ছতা ফিরবে কবে?
সাধারণ যাত্রী ও ডিপো কর্মচারীদের দাবি—
বরিশাল বিআরটিসি ডিপোতে অবিলম্বে দুর্নীতি তদন্তে একটি স্বতন্ত্র টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
নয়তো রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থায় আস্থা পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তারা আশা প্রকাশ করেন,
সরকার যদি নিরপেক্ষ তদন্ত করে এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া দূর করে— তাহলে হয়তো একদিন ‘ফ্যাসিস্টদের আতুরঘর’ বলে পরিচিত এই ডিপো আবারও প্রকৃত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে পারবে।