বরিশালের প্রান্তিক জনপদ চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিস—যেটি ভূমি সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজারও মানুষের ভরসার জায়গা হওয়ার কথা, সেখানে আজ ভর করেছে ভোগান্তি, ক্ষোভ আর দুর্নীতির অন্ধকার। স্থানীয়দের ভাষায় এটি এখন “দুর্নীতির আতুর ঘর”। সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে দালালের কাছে, দিতে হচ্ছে ঘুষের টাকা, তবুও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা।
ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না:
সরেজমিন অনুসন্ধান ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, কোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নামজারি, খাজনা পরিশোধ, খতিয়ান বা নকশা সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে চলছে অঘোষিত ফি আদায়। অফিসে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরে একটি সিন্ডিকেট। তাদের কথামতো টাকা না দিলে ফাইল অকারণে মাসের পর মাস আটকে থাকে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল খালেক বলেন,
> “আমি বাবার জমির নামজারি করতে গিয়েছিলাম। নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ফি জমা দিলেও আমাকে আলাদা করে তিন হাজার টাকা দাবি করা হয়। না দিলে ফাইল এগোয়নি। শেষমেষ দালালের হাতে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়েছে।”
একই অভিযোগ করেন স্কুলশিক্ষক রহিমা বেগম। তিনি জানান, খাজনার রশিদ তুলতে গিয়েও তাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়েছে।
> “সরকার নির্ধারিত ২০ টাকার খাজনা দিতে গিয়ে অফিস থেকে আমাকে বলা হলো ২০০ টাকা না দিলে রশিদ মিলবে না। এটা কি সেবা?”
সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য:
স্থানীয়দের অভিযোগ, অফিসের ভেতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটররা। তারা মাঠের দালালদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি ফাইল থেকে ভাগ বসায়। তহশিলদারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এসব সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
ব্যবসায়ী কাওছার হোসেন বলেন,
> “এখানে আসল কাজের চেয়ে দালালের দৌরাত্ম্য বেশি। সাধারণ মানুষ সরাসরি কাউন্টারে গেলেও কাজ হবে না। দালাল ছাড়া ফাইল নড়ে না।”
ভুক্তভোগীদের দীর্ঘশ্বাস:
ভূমি অফিসে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ সেবা নিতে আসে। কিন্তু বেশিরভাগই অভিযোগ করেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেবা পাওয়া যায় না। অযথা হয়রানি করা হয়, নানা কাগজপত্রের অজুহাতে ফাইল ফেরত পাঠানো হয়।
বৃদ্ধ কৃষক মফিজ উদ্দিন বলেন,
> “আমরা গরিব মানুষ, সামান্য জমির কাগজপত্র ঠিক করতে গেলেই ঘুষ চায়। টাকা না দিলে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। সরকার কি এ জন্য অফিস বসিয়েছে?”
সচেতন মহলের উদ্বেগ:
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। বহুদিন ধরেই এটি চলছে। কিন্তু শাস্তির আওতায় কেউ আসে না।
স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের নেতা শামসুল আলম মনে করেন, এ দুর্নীতি শুধু ভুক্তভোগী নয়, রাষ্ট্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
> “সরকারের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দ্রুত শুদ্ধি অভিযান চালানো জরুরি।”
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি :
ভূমি প্রশাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ফারুক আহমেদ বলেন,> “ভূমি অফিসে দুর্নীতি প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বরিশালের চরমোনাই ইউনিয়ন অফিস তার একটি প্রকট উদাহরণ। এই দুর্নীতি রোধ করতে হলে ডিজিটাল সেবা কার্যকর করা, দালাল চক্রকে আইনের আওতায় আনা এবং কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন,> “সরকার ডিজিটাল ভূমি সেবা চালু করলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। অফিসে এসে এখনও ঘুষ দিতে হচ্ছে। এই সংস্কৃতি না ভাঙলে জনগণ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে না।”
সরকারের শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণা :
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারাদেশে ভূমি অফিসে দুর্নীতি রোধে একটি শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। কোনাই ইউনিয়ন অফিসও তার বাইরে নয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আব্দুর রশিদ বলেন,> “আমরা জানি কিছু ইউনিয়ন অফিসে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। এসব বন্ধে শিগগিরই গোপন অনুসন্ধান করা হবে। কেউ ছাড় পাবে না।”
জনমতের চাপ :
স্থানীয়রা বলছেন, এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ দুর্নীতি আরও বাড়বে। ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাওয়ার নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
গৃহবধূ হাসিনা আক্তার বলেন,> “যতবার অফিসে গেছি, ততবার হতাশ হয়েছি। টাকা ছাড়া কাজ হয় না। অথচ সরকারের ডিজিটাল সেবা নিয়ে কত প্রচারণা চলে।”
চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুর্নীতির কাহিনি আসলে দেশের সার্বিক ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। একদিকে সরকারের আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল সেবার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে দালাল ও ঘুষের রাজত্ব। এর ফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে।
জনমতের প্রত্যাশা—দুর্নীতির এই আতুর ঘর ভেঙে দিয়ে প্রকৃত অর্থে জনগণের জন্য একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ভূমি সেবা নিশ্চিত করা।
সেবাপ্রত্যাশীদের দুর্ভোগ:
চরমোনাই ইউনিয়নের বাসিন্দা রুহুল আমিন জানালেন, তার দাদা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে জমি নামজারি করার আবেদন করেন। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে গেলেও কাজ হয়নি। বারবার অফিসে গেলেও তাকে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে। এক পর্যায়ে তহশিলদারের ঘনিষ্ঠ এক দালাল সরাসরি বলে দেন, “পাঁচ হাজার টাকা দিলে তিন দিনের মধ্যে নামজারি হয়ে যাবে, নইলে ফাইল কখনোই অগ্রসর হবে না।”
একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন গৃহবধূ খালেদা বেগম। তিনি জমির খাজনা দেওয়ার জন্য অফিসে গিয়ে দেখেন কম্পিউটার অপারেটরসহ কয়েকজন কর্মচারী তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখেছেন। পরে ইঙ্গিত দেন, অতিরিক্ত ২০০ টাকা দিলে সাথে সাথে রসিদ দেওয়া হবে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, “ভূমি অফিসে গেলে মনে হয় আমি সেবাগ্রহীতা নই, বরং ভিক্ষুক। সঠিক সরকারি ফি দেওয়ার পরও আবার টাকা দিতে হয়। না দিলে নানা অজুহাতে ফাইল আটকে রাখা হয়।”
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ;
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের বাইরে সবসময় কয়েকজন দালাল অবস্থান করছে। তারা ভূমি অফিসে আগত মানুষদের ধরে ধরে নিজেদের ভিজিটিং কার্ড দিচ্ছে। কাজ করতে হলে তাদের মাধ্যমেই করতে হবে—এমন বার্তা স্পষ্ট। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এ দালালরা সরাসরি তহশিলদারের আশীর্বাদপুষ্ট। অফিসের ভেতরে যেসব কম্পিউটার অপারেটর ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আছেন, তারাও দালালদের সাথে যোগসাজশ করে কাজ ভাগাভাগি করেন।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারী জানান, মাস শেষে উপরের মহল থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল পর্যন্ত ভাগ চলে যায়। সিস্টেমটাই এমনভাবে সাজানো যে, কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
আইনি জটিলতা তৈরির কৌশল;
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তহশিলদার ইচ্ছাকৃতভাবে ফাইলে আইনি জটিলতার দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেন। কারও জমিতে সামান্য ওয়ারিশী বিভাজন বা রেকর্ডে ছোটখাটো ভিন্নতা থাকলে সেটিকে বড় করে দেখানো হয়। তখন আবেদনকারীকে বলা হয়, আদালতের আদেশ লাগবে। অথচ ঘুষ দিলেই ‘অফিস থেকে সমাধান’ সম্ভব হয়ে যায়।
একজন বয়স্ক সেবাপ্রার্থী আব্দুল করিম বলেন, “আমার জমির খাজনা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। পরে শুনলাম অফিসের ভেতরে নাকি টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে। দালালকে দুই হাজার টাকা দেওয়ার পর পরদিনই রসিদ পাই।”
স্থানীয় জনরোষ:
চরমোনাই ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাজারে, মসজিদে, আড্ডায় সর্বত্র আলোচনার বিষয়—ভূমি অফিসের অনিয়ম। অনেকেই সরাসরি অভিযোগ করেছেন, এই দুর্নীতির কারণে সাধারণ কৃষক আর গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
স্থানীয় সমাজকর্মী আক্তারুজ্জামান বলেন, “ভূমি অফিস দুর্নীতির আখড়া হয়ে গেছে। মানুষ এখন আর কোনো সরকারি ফি বা প্রক্রিয়া বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ তারা জানে, ঘুষ ছাড়া কাজ হবে না।”
জনপ্রতিনিধিদের অবস্থান:
চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন সদস্য এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থেকে বলেন, ভূমি অফিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহুবার এসেছে। তবে প্রশাসনিক জটিলতা আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিষয়টি খোলাখুলি বলা যায় না।
একজন ইউপি সদস্য বলেন, “আমরাও বিব্রত হই। জনগণ আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে। কিন্তু ভূমি অফিস তো আমাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নয়। ফলে আমরা কার্যকর কিছু করতে পারি না।”
তহশিলদারের বক্তব্য:
এ বিষয়ে অভিযুক্ত তহশিলদার আমির হোসেন মল্লিক সাংবাদিকদের বলেন, “এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা সরকারি নিয়ম মেনে কাজ করি। যারা অভিযোগ করছেন তারা হয়তো ফাইলের আইনি জটিলতা বুঝতে পারছেন না। অফিসে কোনো সিন্ডিকেট নেই। দালালরা নিজেরাই এখানে আসে, আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।”
তবে স্থানীয়রা তার বক্তব্যকে সরাসরি অস্বীকার করে বলছেন, দালাল ছাড়া অফিসে কোনো কাজ হয় না—এটাই বাস্তবতা।
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া :
বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেন, “চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অনিয়মের অভিযোগ আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে এ ধরনের দালালচক্র ও ঘুষ রোধের চেষ্টা চলছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে—এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সাম্প্রতিক আপডেট :
গত ২০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী একত্র হয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এতে তহশিলদারের বিরুদ্ধে ঘুষ, হয়রানি ও দালাল নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আশ্বাস দিয়েছেন, দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একইদিন বরিশাল প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে ভুক্তভোগীরা বলেন, “চরমোনাই ভূমি অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো।”
বিশেষজ্ঞদের মত :
ভূমি প্রশাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কামরুল হাসান মনে করেন, “বাংলাদেশে ভূমি অফিসগুলো ঐতিহাসিকভাবে দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ডিজিটালাইজেশন কার্যকরভাবে প্রয়োগ না হলে কোনো পরিবর্তন আসবে না। চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ঘটনা আসলে সারা দেশের প্রতিচ্ছবি।”চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আবারও প্রমাণ করেছে, সাধারণ মানুষের মৌলিক সেবা পেতে এখনো ঘুষের কাছে জিম্মি হতে হয়। স্থানীয় জনগণের দাবি—দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া এবং অনলাইন খাজনা ও নামজারি কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করা।
যতদিন পর্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হবে, ততদিন চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিস সাধারণ মানুষের কাছে দুর্নীতির আতুরঘর হিসেবেই পরিচিত থাকবে।